
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বাণিজ্য নীতি—বিশেষ করে ভারত, ব্রাজিল ও অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির ওপর ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চ শুল্ক আরোপ—বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের পথ খুলে দিয়েছে। এর প্রেক্ষাপটে রাশিয়া–চীন–ভারত (RIC) ত্রিমুখী জোট পুনর্জাগরণের উদ্যোগ নিয়েছে মস্কো। চীন এতে উন্মুক্ত সমর্থন জানালেও ভারত এখনো সতর্ক ও হিসাবি কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখছে, যাতে ‘কৌশলগত স্বশাসন’ অটুট থাকে।
BRICS–এর প্রেক্ষাপটে
এই সম্ভাব্য RIC পুনর্জাগরণকে অনেকে বৃহত্তর BRICS কাঠামোর মধ্যে দেখছেন। বর্তমানে BRICS–এ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইন্দোনেশিয়া—মোট ১০টি দেশ সদস্য। তারা মিলিতভাবে বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ক্রয়ক্ষমতা–সমন্বিত জিডিপির প্রায় ৩৭ শতাংশ ধারণ করে। সম্প্রসারিত BRICS এখন ‘BRICS+’ নামে পরিচিত, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য, জ্বালানি, খাদ্য ও কৌশলগত সম্পদের ক্ষেত্রে একটি নতুন শক্তিকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে
BRICS+ দেশগুলো স্থানীয় মুদ্রা ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে মার্কিন ডলার–নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে স্বর্ণ–ভিত্তিক লেনদেন ও মুদ্রা সোয়াপ চুক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি যদি ধারাবাহিকভাবে কার্যকর হয়, তবে ডলার–কেন্দ্রিক বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার ওপর বড় চাপ পড়বে।
চীন–রাশিয়ার কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা
চীন ও রাশিয়া বর্তমানে একে অপরের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। এই ‘ড্রাগন–বিয়ার’ জোট পশ্চিমা আধিপত্যবাদের সরাসরি বিকল্প হয়ে উঠতে চায়। তবে দুই দেশের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস, সীমান্তগত উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
ভারতের ভারসাম্য নীতি
ভারত ‘মাল্টি–অ্যালাইনমেন্ট’ বা বহুমুখী জোটনীতি অনুসরণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন—প্রত্যেকের সঙ্গেই কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখে ভারত নিজের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে চাইছে। রাশিয়া থেকে ছাড়মূল্যে তেল আমদানি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং প্রযুক্তি বিনিময় ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কও ভারতের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, RIC যদি সক্রিয় জোট হিসেবে কাজ শুরু করে, তবে এটি বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী মেরুতে পরিণত হতে পারে। এর মাধ্যমে BRICS–এর ভেতরকার সংহতি আরও সুদৃঢ় হবে এবং উদীয়মান অর্থনীতিগুলো একে অপরের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। তবে এই জোটের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক আস্থা, অর্থনৈতিক নীতি সমন্বয় এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কীভাবে মোকাবিলা করা হয় তার ওপর।
সারকথা, রাশিয়া–চীন–ভারত ঘনিষ্ঠ হলে তা শুধু আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকেই বদলাবে না, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও কূটনীতিতেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাতে পারে। কিন্তু পথটি মোটেও সহজ নয়—অর্থনৈতিক স্বার্থ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং ঐতিহাসিক সন্দেহই এই জোটের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়ে থাকবে।